করোনা সঙ্কটে কক্সবাজারে কৃষি উৎপাদন সচল রাখতে বহুমুখি কার্যক্রম, মাঠে মাঠে কৃষিবিদ আবুল কাশেম

আবদুল্লাহ আল আজিজ,কক্সবাজার জার্নাল ◑ 

ভয়াবহ করেনাভাইরাস আতঙ্কের ভয়াল থাবার মধ্যেও উৎপাদনের ধারা সচল রাখার বহুমুখি কার্যক্রম হাতে নিয়েছে কৃষি বিভাগ।

তারই ধারাবাহিকতায় কৃষিপ্রধান দেশে মাঠে মাঠে চলছে কর্মবীর কৃষকদের উৎপাদনের যুদ্ধ। কক্সবাজার জেলায় সাবধানতা অবলম্বন করে কৃষি উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয়, কার্যক্রম থমকে না যায়, খাদ্যের যোগান অব্যাহত থাকে-তার জন্য দিনরাত সমানতালে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কক্সবাজার জেলার উপপরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ আবুল কাশেম।

এরমধ্যে জেলার ৭১টি ইউনিয়ন, ৪ পৌরসভায় করোনা কালীন সময়ে বিভিন্ন এলাকায় বোরো ধানের প্রদর্শনী সহ বিভিন্ন কৃষি প্রদর্শনী পরিদর্শন করে কৃষকদের ধানকাটাসহ নানান সমস্যা নিয়ে সাহায্য, পরামর্শ দিয়ে গেছেন। মাঠপর্যায়ের সকল কর্মকর্তাদের কৃষকদের পাশে থেকে সাহস যোগানো, উপকরণ নির্বিঘ্নে হাতে পাবার ব্যবস্থা করছেন তিনি।

লকডাউনে দেশে সবকিছু থেমে গেলেও থেমে থাকেনি এবারের বোরো ফসলের বেড়ে উঠা। আর এই সময়ে কৃষকের দরকার ছিল ঝুঁকি মোকাবেলায় পরামর্শ ও সেবা। সেই সেবা কৃষকের দ্বোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে তারই নির্দেশনায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা নিরলস ভাবে কাজ করে গেছেন। যার ফলে জেলায় এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষকের ফুটেছে হাসি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র মতে, বোরো ধান কিনতে কৃষক তালিকা তৈরি, আউশ ধানের প্রণোদনায় কৃষক তালিকা তৈরি, করোনা ভাইরাস সম্পর্কে কৃষকদের মাঝে সচেতনতা পাশাপাশি ধানের ব্লাস্ট রোগ দমনসহ অন্য রোগ ও পোকার দমন, কৃষি কার্ড হালনাগাদ, ইউনিয়নে ট্যাগ অফিসারের দায়িত্ব পালনসহ নানা ধরণের কাজ করে গেছেন এই করোনা পরিস্থিতিতে।

এছাড়াও শ্রমিক সংকট মোকাবিলায় জেলার কৃষকদের মধ্যে ৪ টি কম্বাইন হারভেষ্টার বিতরণ ও রিপার যন্ত্র দ্বারা ধান কাটা হয়েছে।

অন্যদিকে, সম্প্রতি ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে কক্সবাজারের টেকনাফে পঙ্গপালের আক্রমণ শুরু হয়েছে। টেকনাফের লম্বরী গ্রামের একটি বাড়ির আম গাছসহ বিভিন্ন ফলজ ও বনজ গাছের শাখা-প্রশাখায় সম্প্রতি দেখা মিলে এক ধরনের এ পোকা। পোকাগুলো গাছের পাতা সম্পূর্ণ রূপে খেয়ে ফেলছে। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে হৈচৈ পড়ে যায়। এই অবস্থায় এই গুজবে কান দিয়ে দেশের কৃষক ও কৃষি খামারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

কিন্তু এই অবস্থায় তিনি দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে কৃষি মন্ত্রনালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে দ্রুত যোগাযোগ করে উনাদের নিয়ে ছুটে যান টেকনাফে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের পর নিশ্চিত করেন যে টেকনাফের লম্বরী গ্রামে গাছে যে পোকাগুলো বসছে এবং গাছের ক্ষতি করছে, সেই আলোচিত পোকা পঙ্গপাল নয়। এটি তেমন ক্ষতিকর পোকাও নয়। এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

পরে তিনি ও স্থানীয় কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে কীটনাশক প্রয়োগ করে পোকাগুলো দমন করেন। এটি ছিল আরেকটি সাফল্য।

এদিকে গত সপ্তাহ যাবত জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পতিত জমির জন্য সবজি বিতরণ অব্যাহত রেখে সামনের আমন মৌসুমে আধুনিক বীজতলা স্থাপন, সঠিক বয়সের চারা রোপন, সুষম সারের ব্যবহার, লোগো পদ্ধতি অনুসরণ, পার্চিং করতে জেলার কৃষকদের অনুরোধ জানান তিনি।

করোনার এই দূর্যোগেও একজন উপপরিচালকের নিরলস পরিশ্রম ও মানুষের পাশে থেকে কাজ তদারকি করায় সাধুবাদ জানিয়েছেন সবাই।

খুনিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মাবুদ জানান, এ বছর বোরোধানের বাষ্পার ফলন হয়েছে।

চেয়ারম্যান আরো বলেন, তার নিজ ইউনিয়নে ডিডি আবুল কাশেম মহোদয় বোরো মৌসুমে ৪বার পরিদর্শনে এসেছেন। তাছাড়াও শস্য কর্তন অনুষ্ঠানে জেলার একজন শীর্ষ কর্মকর্তা পাশে পেয়ে কৃষকরা অনেক খুশি হয়েছেন ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

উখিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ দোলন চন্দ্র রায় বলেন, বর্তমান সরকার কৃষিবান্ধব সরকার, কৃষিতে সরকার ৯শত কোটি টাকা সার বীজ যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকি দিয়েছেন।

তিনি আরো বলেন, কৃষকের ক্ষেতও যখন করোনার ঝুঁকিতে ঝুঁকিপূর্ণ, এমতাবস্থায় আমরা ডিডি স্যারের দিক নির্দেশনা অনুযায়ী কৃষকদের দোরগোড়ায় গিয়ে কৃষিসেবা দিয়ে যাচ্ছি। কাজ করতে গিয়ে করোনার ঝুঁকি থাকলেও কৃষকদের কথা ভেবে সাধারণ ছুটির মধ্যেও মাঠ পর্যায়ে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি আমরা।

কক্সবাজার সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ গোলাম সরওয়ার তুষার বলেন, এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলনে কৃষকের পরিশ্রম ও ডিডি স্যারের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সহযোগিতার ফল এটি। এবার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিতও হয়েছে। গুদামে ধান বেচা-কেনায় আমরা কৃষকের হয়ে সহযোগিতা করবো। যাতে কোনো কৃষক অতীতের মত হয়রানি না হয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কক্সবাজার জেলার উপপরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ আবুল কাশেম বলেন, বৈশ্বিক মহামারী করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। কেননা এই সময়ে কৃষকের পাশে থাকাটা আমারদের ঈমানী দায়িত্ব। এমনিতে মানুষ করোনার কারণে ঘরবন্দী হয়ে দুশ্চিন্তায় আছে। তাদের পাশে থেকে কাজ না করলে ধান তোলাটা অসম্ভব হয়ে যেত। তাই ধান কাটার জন্য শ্রমিকের যাতায়াত নির্বিঘ্নে করা, কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং শ্রমিকদের ধান কাটায় উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে ধান ঘরে তোলাটা সহজ হয়েছে।

কেননা এ ফসল ফলাতে কৃষকরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন এবং সার, সেচ, বালাইনাশকসহ প্রভৃতিতে তার সর্বস্ব বিনিয়োগ করে। এ ফসল যদি নষ্ট হয়, সময়মতো ঘরে না তোলা যেত- তা হলে কৃষক অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হত এবং দেশে খাদ্যের সংকট সৃষ্টি হত।

এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ‘কোথাও এক ইঞ্চি জমিও যেন ফাকা পড়ে না থাকে।’ এটি বাস্তবায়ন করতে কৃষি অফিস কাজ করে যাচ্ছে। সে লক্ষে বিভিন্ন এলাকা থেকে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। ফলে কৃষকরা চাষে আগ্রহী হচ্ছে। পতিত জমির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে নিরাপদ সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে বলে তিনি জানান।

তাছাড়া ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যেমে চাষিদের সচেতন করতে পারলে কক্সবাজারের প্রতিটি পতিত জমির ব্যবহার হবে, অপরদিকে সাধারণ মানুষ বিষমুক্ত সবজি পাবে।

তাই কৃষকদের সঠিক সময়ে আগামী আমন মৌসুমে সঠিক বয়সের চারা রোপন, জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধি, লোগো পদ্ধতি অনুসরন ও পার্চিং লাগানোর প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।

তাই আমরা কৃষকের সাথে আছি এবং কৃষকের দৌড়গোড়ায় সেবা দিতে কৃষি বিভাগের লোকজন সার্বক্ষণিক মাঠে কাজ করে যাব।

তিনি আরো বলেন,  দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে ব্যতিক্রম কৃষি উৎপাদনের সাথে জড়িত মাঠ পর্যায়ের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারিগণ কোন বিশেষ প্রণোদনা বা প্রশংসা কুড়ানোর জন্য নয় বরং এ দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে কৃষি ও কৃষককে ভালবেসে ক্ষুধার অন্য যোগাতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। মাঠে প্রান্তরে কাজের ব্যাপক বিস্তৃতি, স্মার্ট কৃষি বাস্তবায়নে সীমিত সম্পদ, যানবাহনের সঙ্কট এমনকি যানবাহনজনিত দূর্ঘটনায় কবলিত হওয়া সত্ত্বেও অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে শোনা যাচ্ছে বিশ্বের অনেক ধনী দেশ তাদের উৎপাদিত উদ্বৃত্ত ফসলের বাজার মূল্য কমে যাওয়ায় বিক্রি না করে মাঠেই মিশিয়ে দিচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য রাজনীতিতে এটা নতুন কোন বিষয় নয়। করোনা পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতিতে বিশ্বের অনেক দেশই এসব কূট রাজনীতির শিকার হবে বলার অপেক্ষা রাখে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন এক ইঞ্চি জায়গা ফেলে রাখা যাবে না, আবাদ করতে হবে। বসতবাড়ির আনাচে-কানাচে এমনকি শহরাঞ্চলে টবে ফসল ফলানোর পরামর্শ প্রদান করেছেন। করোনা পরিস্থিতি কতদিন দীর্ঘায়িত হবে কিংবা টাকা থাকলেও করোনা পরবর্তী খাবার কিনতে পাওয়া যাবে কিনা এ নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে আমাদের খাদ্য দিয়ে সাহায্য করতে হতে পারে। বিশ্ব মহামারীর এ মুহুর্তে তাঁর এ দূরদর্শী পরিকল্পনা ও সদয় দিকনির্দেশনা বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নে কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিশ্চিতভাবে বিশেষ অনুপ্রেরণা যোগাবে।